তোমার প্রিয় মানুষ বাংলা রচনা
ভূমিকাঃ
সভ্যতার ইতিহাস মহাপুরুষদের সাধনা, ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের মহিমায় ভাস্বর। মুক্তিমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে যুগে যুগে কত না অপরিমেয় ত্যাগ স্বীকার ও দুঃখবরণ করেছেন তাঁরা। সত্যের জ্যোতিতে বিশ্বলোককে উদ্ভাসিত করতে গিয়ে নিজেদের তিলে তিলে দহন করেছেন। তাঁদের আত্মবলিদান, তিতিক্ষা ও সত্যানুসন্ধিৎসা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়নি। কারণ জীবনের যাত্রাপথে কোটি কোটি নরনারী আজও তাঁদের জীবন থেকেই অনুপ্রেরণা পায়, তাঁদের আদর্শ ও সত্যদৃষ্টি দিশাহারা পথহারা মানুষকে আজও নিত্যনতুন কল্যাণবোধে উদ্দীপ্ত করে। হযরত মুহম্মদ (সাঃ) বিশ্বজনের হৃদয়াকাশে যে নতুন জ্যোতির্মন্ডল উন্মুক্ত করে গেছেন, আত্মদ্বন্দ্বে কলুষিত ও স্বার্থচিন্তায় নিমগ্ন চিত্ত অসহায়, পঙ্গু ও দুর্বল মানুষের কাছে তা অন্ধকারে আলো, দুঃখে সান্তনা, পতনে আশ্রয় ও রোগে মুক্তি। হযরত মুহম্মদ (সাঃ)-এর উদার মানবিকবতা ও অখন্ড সত্যদৃষ্টি শুধুমাত্র দেশ, কাল বা সম্প্রদায় বিশেষের ক্ষুদ্র গন্ডীর মধ্যে আবদ্ধ থাকেনি, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে শত শত বছর ধরে অগণিত মানুষকে সত্যধর্মে উদ্বুদ্ধ করছে। তাঁকে স্মরণের মধ্যে দিয়ে আমরা যে সুযোগ পাই তা শুধু আমাদের আত্মদর্শনেই সাহায্য করে না, আমাদের আত্মশুদ্ধির পথকেও প্রশস্ত করে।
জন্ম ও বংশ পরিচয়ঃ
আরবের মক্কা নগরে ৫৭০ খৃষ্টব্দের ২৪শে আগষ্ট (১২ ই রবিউল আউয়াল) ইসলাম ধর্মের পবর্তক ও বিশ্বের আশীর্বাদ হযরত মুহম্মদ (সাঃ)-এর জন্ম হয়। তাঁর পিতা আবদুল্লাহ ও মাতা বিবি আমিনা ছিলেন প্রতিপত্তিশালী কোরেশ সম্প্রদায়ের মান্যগণ্য নাগরিক। দুর্ভাগ্য, হযরত মুহম্মদ (সাঃ) জন্মের আগেই পিতাকে হারান। জননী আমেনার যখন মৃত্যু হয় তখন তাঁর বয়স মাত্র ছয় বছর। পিতামাতাহীন অসহায় হযরত মুহম্মদ (সাঃ)-কে দেখাশুনার ভার নিলেন তাঁর ধনী পিতামহ মোতালেব ও পিতৃব্য আবু তালেব। ছেলেবেলায় হযরত মুহম্মদ (সাঃ) লেখাপড়ার বিশেষ সুযোগ পাননি। কিন্তু অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পেয়েছিলেন প্রচুর। তাঁর চাচা আবু তালেব ছিলেন ব্যবসায়ী; তাঁকে উট নিয়ে তাঁর চাচার সঙ্গে আরব দেশের নানা জায়গায় যাতায়াত করতে হত। তখন তিনি ইহুদী ও খৃষ্টান ব্যবসায়ীদের কাছে তাঁদের ধর্ম সম্বন্ধে নানা বিচিত্র কথা শুনতেন। এছাড়া উটের বহরের সঙ্গে আরবের মরুভূমি অঞ্চলের দূরধুরান্তরে যাতায়াত করার সময় তিনি আরবীয়দের জীবনযাত্রা ও তাদের জীবনের সমস্যাগুলোর সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ পেয়েছিলেন।
হযরত মুহম্মদ (সাঃ)-এর সমসাময়িক সামাজিক পরিবেশঃ
সে যুগে আরবরা ছিলেন খন্ড, ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত। তাঁদের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব লেগেই থাকত। পারস্পরিক লড়াইয়ের ফলে নিয়ত রক্তাক্ত হত আরব দেশের ভূমি। মক্কা-মদীনার বণিকরা অবশ্য সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন অতিবাহিত করতেন। অন্তহীন বিলাসিতা ও বিপুল ঐশ্বর্য-আড়ম্ববের মধ্যে তাঁদের দিন কাটত। কিন্তু জনসাধারণের জীবন ছিল অশেষ দুঃখ-কষ্টে পরিপূর্ণ। এছাড়া, একদিকে অশিক্ষা ও কুশিক্ষার নাগপাশ এবং অন্যদিকে নানা ধরনের কুসংস্কারের বেড়াজাল তাদের উপর দুর্বিষহ প্রভাব বিস্তার করেছিল। ধর্মের নামে তখন প্রচলিত ছিল কিছু অন্ধ কুসংস্কার, হাস্যকর গোঁড়ামি ও অর্থহীন আচার-অনুষ্ঠান। আরবদের মধ্যে সে যুগে নানা ধরনের মূর্তিপূজার প্রচলন ছিল। মক্কাতীর্থের পান্ডারা অসংখ্য মূর্তিপূজাকে উপলক্ষ করে ধর্মার্থীদের কাছ থেকে অর্থ লুন্ঠন করতেন। হযরত মুহম্মদ (সাঃ) এই শোষণ প্রবৃত্তি এবং বিভিন্ন ধর্মের ভেতর কুসংস্কার দেখে ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত হলেন। তাঁর একমাত্র চিন্তা হলো এসব জুলুম ও কুসংস্কার থেকে মানুষের মুক্ত করে তাদের উদ্ধার করা।
বিবাহ, ধ্যান-নিমগ্নতা, ঐশীবাণী শ্রবণঃ
হযরত মুহম্মদ (সাঃ)-এর বয়স যখন পঁচিশ বছর তখন তিনি খাদিজা নামী এক সম্ভ্রান্ত মহিলাকে বিবাহ করেন। বিবি খাদিজার আর্থিক অবস্থা খুব ভাল ছির বিধায় হযরত মুহম্মদ (সাঃ)-এর অভাব-অনটন দূর হলো এবং তিনি একাগ্রচিত্তে আল্লাহর ধ্যানে আত্মনিয়োগ করলেন। মক্কার অনতিদূরে অবস্থিত ‘হরো’ পর্বতের গুহায় তিনি গভীর ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন। সুদীর্ঘ পনের বছর ধ্যান করার পর তিনি আল্লাহর দূত জিব্রাঈল (আঃ)-এর দর্শন পান। তিনি হযরত জিব্রাইল (আঃ)-এর কাছে আল্লাহর বাণী শুনতে পান। হযরত মুহম্মদ (সাঃ)-এর নিকট একদিন ঐশীবাণী হলো, ‘আল্লাহ এক, অদ্বিতীয়, তিনি তাঁরই প্রেরিত পুরুষ বা রসূল’।
নতুন ধর্মমত প্রচার, প্রতিকূলতা, মদীনায় হিযরত, মক্কা অধিকার, পরলোকগমনঃ
চল্লিশ বছর বয়সে হযরত মুহম্মদ (সাঃ) এই ঐশীবাণী শোনেন। কথিত আছে, এর পর থেকেই তিনি মানুষ তিনি, নতুন দিব্যদৃষ্টির প্রভাবে তিনি মহিমময়। হযরত মুহম্মদ (সাঃ) প্রথমে তাঁর নতুন ধর্মমত নিকট আত্মীয়-পরিজনদের মধ্যে প্রচার করতে সচেষ্ট হন। তাঁর স্ত্রী খাদিজা, বন্ধু আবু বকর, জ্ঞাতিভাই আলী প্রমুখ মুষ্টিমেয় কয়েকজন তাঁর ধর্মমত গ্রহণ করেন, কিন্তু পৌত্তলিক মক্কাবাসীদের কাছে ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে তিনি প্রবল বাঁধার সম্মুখীন হন। নানা অত্যাচার ও নিপীড়ন চলতে থাকে তাঁর উপর। এমন কি তাঁর প্রাণনাশের চেষ্টায় কেউ কেউ মেতে ওঠেন। হযরত মুহম্মদ (সাঃ) গোপনে এ হীনচক্রান্তের খবর পাওয়া মাত্রই কয়েকজন সাহাবীকে নিয়ে ৬২২ খৃষ্টাব্দে মক্কা থেকে মদীনায় হিযরত করেন। এ সময় থেকেই মুসলমানদের হিজরী সালের গণনা শুরু। মদীনার অধিবাসীরা হযরত মুহম্মদ (সাঃ)-কে সাদরে গ্রহণ করেন এবং সেখানে তিনি তাঁর নতুন ধর্মমত প্রচার করতে থাকেন। দেখতে দেখতে তাঁর সাহাবীর সংখ্যা বেড়ে চলে। অসংখ্য নরনারী শ্রদ্ধাবানচিত্তে তাঁর ধর্মমতকে গ্রহণ করলেন। অবশেষে ৬৩০ খৃষ্টাব্দে সাহাবীবর্গের সাহায্যে তিনি মক্কা অধিকার করেন। এবার মক্কার অধিবাসীরাও দলে দলে তাঁর ধর্মমতে দীক্ষা নেন, আরব অঞ্চলে তাঁর জনপ্রিয়তা হয়ে ওঠে অপ্রতিহত। এভাবে প্রতিকূল পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে অবিরাম সংগ্রাম করতে করতে অগণিত শত্রুকে মিত্রপথে অভিষিক্ত করতে করতে সত্যদ্রষ্টা এ মহামানব পরলোকগমন করেন ৬৩২ খৃষ্টব্দে।
কুরআন ও ইসলামঃ
আল্লাহর নিকট থেকে হযরত মুহম্মদ (সাঃ) যে বাণী ও আদেশ পেয়েছিলেন তা ‘কুরআন” নামক পবিত্র ধর্মগ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা আছে। হযরত মুহম্মদ (সাঃ) কর্তৃক প্রচারিত ধর্ম ‘ইসলাম’ নামে অভিহিত। ‘ইসলাম’ শব্দের অর্থ ‘শান্তির মধ্যে আত্মস্থ হওয়া’। কুরআনের মতে, ইসলাম হযরত মুহম্মদ (সাঃ) কর্তৃক প্রবর্তিত নতুন কোন ধর্ম নয়, এই ধর্মাদর্শ বহুকাল থেকেই ছিল। পুরাতন নীতিগুলোকে হযরত মুহম্মদ (সাঃ) নতুন করে ব্যাখ্যা করেছেন, নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছেন তাদের মধ্যে।
হযরত মুহম্মদ (সাঃ)-এর ধর্মমতঃ
ইসলামের নীতি ও আদশ্য সম্বন্ধে হযরত মুহম্মদ (সাঃ) ঘোষণা করলেন, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলেই আল্লাহর কাছে এক। জাতি, ধর্ম ও বর্ণগত পার্থক্য মানুষকে আল্লাহর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে না। যে তাঁর কাছে আত্মনিবেদন করেছে, সে-ই মুসলিম। মানুষে মানুষে প্রেম, প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন দৃঢ় করবার জন্যে তিনি সমবেত নামায, যাকাত, হজ্ব, জিহাদ প্রভৃতি ধর্মকার্যের নির্দেশ দিয়েছেন। হযরত মুহম্মদ (সাঃ) বলেন, আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় এবং হযরত নিজে হলেন আল্লাহর প্রেরিত নবী। তাঁর প্রচারিত ধর্ম যারা গ্রহণ করবেন, তাঁরা হবে মুসলমান। হযরত মুহম্মদ (সাঃ) অনুগামীদের জন্যে কোরবাণীর কথা বলেন।
ইসলামের বাণীঃ
হযরত মুহম্মদ (সাঃ) আল্লাহর প্রেরিত দূত হিসেবে ইসলাম ধর্মই শুধু প্রচার করলেন না, আরব দেশ, আফ্রিকা তথা বিশ্বের ইতিহাসও গড়লেন নতুনভাবে। তাঁরই প্রভাবে জড়বৎ আরব সভ্যতায় এল নতুন প্রাণোন্মাদনা। ইসলামের বাণী নিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়লেন। দেশে দেশে ইসলামের পবিত্র আদর্শ পৌঁছল। প্রতিষ্ঠিত হলো ইসলাম ধর্ম নির্ভর নতুন নতুন রাজ্য। ইসলাম অনুরাগীদের কন্ঠে ধ্বনিত হলো হযরত মুহম্মদ (সাঃ)-এর বাণী- আল্লাহ নিরাকার, চৈতন্যময়, এক, অদ্বিতীয়। তাঁর কোনরূপ আকার কল্পনা করা অসঙ্গত, অর্থ লাভের ব্যবসা ছাড়া কিছু নয়। কুরআনের মতে, যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে শান্তির বন্ধনে আবদ্ধ হতে পেরেছে, সেই মুসলিম। আল্লাহর সঙ্গে শান্তির বন্ধনের অর্থ তার নিকট সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ। মানুষের সঙ্গে শান্তির সম্পর্ক বলতে বুঝায় অপরকে আঘাত ও তার অনিষ্ট করার প্রবৃত্তি থেকে নিজের মন প্রাণকে নিরস্ত করা। কুরআনে এই দুটি তত্ত¡ ইসলামের সারমর্ম হিসেবে বর্ণিত।
উপসংহারঃ
হযরত মুহম্মদ (সাঃ)-এর জীবন ও সাধনার মধ্যে ইসলামের মর্মবাণী উদ্ভাসিত। শুধু ইসলামের কথাই বা বলি কেন, সমগ্র মানব-সমাজের মুক্তি ও কল্যাণমন্ত্র আমরা তাঁর পবিত্র জীবন-চরিত্রের মধ্যে খুঁজে পাই। আজকের পৃথিবীতে মানুষের বৈষয়িক উন্নতি অনেক হচ্ছে, কিন্তু আত্মিক উন্নতির পথ ক্রমশই যেন সংকুচিত হয়ে আসছে। তাই মানুষের সম্পদ আছে শান্তি নেই; শক্তি আছে সুখ নেই; বিদ্যা আছে জ্ঞান নেই। এমন দিনে হযরত মুহম্মদ (সাঃ)-এর মত নবীর জীবনাদর্শ যত বেশি আলোচিত হবে ততই মঙ্গল।